ঢাকা ০৫:২৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ৩ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সদকাতুল ফিতরের মৌলিক বিধান

  • আপডেট সময় : ০৩:১০:৪১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ মার্চ ২০২৪ ৩৬৩ বার পড়া হয়েছে

সদকাতুল ফিতর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। যা পবিত্র রমজান মাসের শেষে ঈদুল ফিতরের দিন আদায় করতে হয়। এটি জাকাতেরই একটি প্রকার। একে জাকাতুল ফিতর এবং ফিতরাও বলা হয়। পবিত্র কোরআনে এর প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। এ ছাড়া হাদিসে এটি আদায়ের ব্যাপারে বিশেষ তাগিদ বর্ণিত হয়েছে। পাশাপাশি শেখানো হয়েছে এর নিয়মনীতি। ফলে নবীজির যুগ থেকে আজ পর্যন্ত অন্যান্য মৌলিক ইবাদতের মতো সদকাতুল ফিতরও মুসলমানেরা আদায় করে আসছেন।

সদকাতুল ফিতরের গুরুত্ব
পবিত্র কোরআনে স্পষ্ট শব্দে সদকাতুল ফিতরের কথা উল্লেখ করা হয়নি। তবে এর প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই সাফল্য অর্জন করবে সে, যে পবিত্রতা অর্জন করবে এবং তার প্রতিপালকের নাম স্মরণ করবে ও সালাত আদায় করবে।’ (সুরা আলা: ১৪-১৫)

সাহাবি ও তাবেয়িদের একটি উল্লেখযোগ্য দল মনে করেন, এ আয়াতে পবিত্রতা বলতে সদকাতুল ফিতর বোঝানো হয়েছে। অবশ্য অনেক আলিমের মতে, এখানে জাকাত উদ্দেশ্য। আবার কেউ নিজেদের আমলের মাধ্যমে মনের পবিত্রতার কথা বুঝিয়েছেন। মোটকথা, সদকাতুল ফিতরের ব্যাপারে আয়াতটি দ্ব্যর্থহীন না হলেও ইঙ্গিতবহ।

এ প্রসঙ্গে হাদিসের বক্তব্য একেবারে দ্ব্যর্থহীন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষের ওপর রমজানে সদকাতুল ফিতর আবশ্যক করেছেন—প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, গোলাম-স্বাধীনের ওপর এক সা খেজুর বা এক সা যব।’ (সহিহ্ বুখারি) উল্লেখ্য, এক সা সমান ৩ কেজি ২৭০ গ্রামের কিছু বেশি। তবে সদকাতুল ফিতর হিসাব করার সময় ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম ধরে সাধারণত হিসাব করা হয়।

আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) একজন ঘোষক প্রেরণ করলেন, সে যেন মক্কার পথে পথে এ ঘোষণা দেয়—ভালো করে শোনো, প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, গোলাম-স্বাধীন, ছোট-বড় সকলের ওপর সদকাতুল ফিতর অপরিহার্য। দুই মুদ তথা আধা সা গম অথবা অন্য কোনো খাদ্যদ্রব্য থেকে এক সা। (তিরমিজি) উল্লেখ্য, আধা সা সমান ১ কেজি ৬৩৫ গ্রামের কিছু বেশি। তবে সদকাতুল ফিতর হিসাব করার সময় ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম ধরে সাধারণত হিসাব করা হয়।

সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ
ওপরের মূলনীতির আলোকেই ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, এ বছর জনপ্রতি সর্বোচ্চ ২ হাজার ৯৭০ টাকা এবং সর্বনিম্ন ১১৫ টাকা ফিতরা দিতে হবে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গম বা আটা দিয়ে ফিতরা আদায় করলে ১ কেজি ৬৫০ গ্রামের বাজারমূল্য ১১৫ টাকা দিতে হবে। যব দিয়ে আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রামের বাজারমূল্য ৪০০ টাকা, খেজুর দিয়ে আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রামের বাজারমূল্য ২ হাজার ৪৭৫ টাকা, কিশমিশ দিয়ে আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রামের বাজারমূল্য ২ হাজার ১৪৫ টাকা এবং পনির দিয়ে আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রামের বাজারমূল্য ২ হাজার ৯৭০ টাকা ফিতরা প্রদান করতে হবে।

সদকাতুল ফিতর কেন দিতে হয়
সদকাতুল ফিতরের মূলকথা হলো, এটি একটি বিশুদ্ধ ইবাদত, যা আদায়ের জন্য স্পষ্টভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সদকাতুল ফিতরের আরও দুটি তাৎপর্যের কথা একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) সদকাতুল ফিতর অপরিহার্য করেছেন; অর্থহীন, অশালীন কথা ও কাজের কারণে রোজার যে ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণের জন্য এবং নিঃস্ব লোকদের আহার জোগানোর জন্য। (আবু দাউদ)

সদকাতুল ফিতর কখন ওয়াজিব হয়
সদকাতুল ফিতর একজন মুসলিমের ওপর নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলেই ওয়াজিব হয়ে যায়। নিসাব পরিমাণ মানে হলো—সোনা, রুপা, ব্যবসায়িক পণ্য, প্রয়োজনের অতিরিক্ত আসবাবপত্রের মূল্য ও নগদ ক্যাশ—এ পাঁচ ধরনের সম্পদ মিলে বা এর কোনো একটিও যদি সাড়ে সাত ভরি সোনা কিংবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায়, তাহলে তাদের ওপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হয়ে যায়। এখানে লক্ষণীয় হলো, প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ বলতে উদ্দেশ্য হলো—যা বছরে সাধারণত একবারও ব্যবহার হয় না। যেমন—
-অতিরিক্ত কাপড়চোপড়, যা বছরে একবারও ব্যবহার হয় না।
-টেলিভিশন, অবৈধ মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট ইত্যাদি
-শৌখিন আসবাবপত্র—তা ব্যবহৃত হোক বা না হোক। যেমন মাছের এ্যকুরিয়াম, পোষা পাখি ইত্যাদি।
-অতিরিক্ত ডেগ-পাতিল যেগুলো বছরে একবারও ব্যবহার হয় না।
-প্রয়োজনের অতিরিক্ত জমি, যা বছরে খোরাকির জন্য প্রয়োজন হয় না।
-খালি পড়ে আছে এমন ঘরবাড়ি।
এসব বিষয় যদিও জাকাতের নিসাবে ধর্তব্য নয়, কিন্তু জাকাতের অনুপযুক্ত হওয়া, সদকাতুল ফিতর ও কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই ধর্তব্য হবে।

বিবিধ মাসায়েল
ক. সদকাতুল ফিতর ব্যয়ের খাত তা-ই, যা জাকাতের খাত। তবে গরিব-মিসকিনকে দেওয়াই সর্বোত্তম।
খ. যে ব্যক্তি যেখানে বসবাস করছে সেখানকার হিসেবেই সদকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে।
গ. নাবালক ও পাগলের সম্পদে জাকাত না আসলেও সদকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে। তাদের পক্ষে তাদের অভিভাবক তা আদায় করবেন।
ঘ. সদকাতুল ফিতর গ্রহীতাকে যা দেওয়া হবে তার মালিকানা সত্ত্ব প্রদান করতে হবে।

লেখক: শিক্ষক

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

সদকাতুল ফিতরের মৌলিক বিধান

আপডেট সময় : ০৩:১০:৪১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ মার্চ ২০২৪

সদকাতুল ফিতর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। যা পবিত্র রমজান মাসের শেষে ঈদুল ফিতরের দিন আদায় করতে হয়। এটি জাকাতেরই একটি প্রকার। একে জাকাতুল ফিতর এবং ফিতরাও বলা হয়। পবিত্র কোরআনে এর প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। এ ছাড়া হাদিসে এটি আদায়ের ব্যাপারে বিশেষ তাগিদ বর্ণিত হয়েছে। পাশাপাশি শেখানো হয়েছে এর নিয়মনীতি। ফলে নবীজির যুগ থেকে আজ পর্যন্ত অন্যান্য মৌলিক ইবাদতের মতো সদকাতুল ফিতরও মুসলমানেরা আদায় করে আসছেন।

সদকাতুল ফিতরের গুরুত্ব
পবিত্র কোরআনে স্পষ্ট শব্দে সদকাতুল ফিতরের কথা উল্লেখ করা হয়নি। তবে এর প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই সাফল্য অর্জন করবে সে, যে পবিত্রতা অর্জন করবে এবং তার প্রতিপালকের নাম স্মরণ করবে ও সালাত আদায় করবে।’ (সুরা আলা: ১৪-১৫)

সাহাবি ও তাবেয়িদের একটি উল্লেখযোগ্য দল মনে করেন, এ আয়াতে পবিত্রতা বলতে সদকাতুল ফিতর বোঝানো হয়েছে। অবশ্য অনেক আলিমের মতে, এখানে জাকাত উদ্দেশ্য। আবার কেউ নিজেদের আমলের মাধ্যমে মনের পবিত্রতার কথা বুঝিয়েছেন। মোটকথা, সদকাতুল ফিতরের ব্যাপারে আয়াতটি দ্ব্যর্থহীন না হলেও ইঙ্গিতবহ।

এ প্রসঙ্গে হাদিসের বক্তব্য একেবারে দ্ব্যর্থহীন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষের ওপর রমজানে সদকাতুল ফিতর আবশ্যক করেছেন—প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, গোলাম-স্বাধীনের ওপর এক সা খেজুর বা এক সা যব।’ (সহিহ্ বুখারি) উল্লেখ্য, এক সা সমান ৩ কেজি ২৭০ গ্রামের কিছু বেশি। তবে সদকাতুল ফিতর হিসাব করার সময় ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম ধরে সাধারণত হিসাব করা হয়।

আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) একজন ঘোষক প্রেরণ করলেন, সে যেন মক্কার পথে পথে এ ঘোষণা দেয়—ভালো করে শোনো, প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, গোলাম-স্বাধীন, ছোট-বড় সকলের ওপর সদকাতুল ফিতর অপরিহার্য। দুই মুদ তথা আধা সা গম অথবা অন্য কোনো খাদ্যদ্রব্য থেকে এক সা। (তিরমিজি) উল্লেখ্য, আধা সা সমান ১ কেজি ৬৩৫ গ্রামের কিছু বেশি। তবে সদকাতুল ফিতর হিসাব করার সময় ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম ধরে সাধারণত হিসাব করা হয়।

সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ
ওপরের মূলনীতির আলোকেই ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, এ বছর জনপ্রতি সর্বোচ্চ ২ হাজার ৯৭০ টাকা এবং সর্বনিম্ন ১১৫ টাকা ফিতরা দিতে হবে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গম বা আটা দিয়ে ফিতরা আদায় করলে ১ কেজি ৬৫০ গ্রামের বাজারমূল্য ১১৫ টাকা দিতে হবে। যব দিয়ে আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রামের বাজারমূল্য ৪০০ টাকা, খেজুর দিয়ে আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রামের বাজারমূল্য ২ হাজার ৪৭৫ টাকা, কিশমিশ দিয়ে আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রামের বাজারমূল্য ২ হাজার ১৪৫ টাকা এবং পনির দিয়ে আদায় করলে ৩ কেজি ৩০০ গ্রামের বাজারমূল্য ২ হাজার ৯৭০ টাকা ফিতরা প্রদান করতে হবে।

সদকাতুল ফিতর কেন দিতে হয়
সদকাতুল ফিতরের মূলকথা হলো, এটি একটি বিশুদ্ধ ইবাদত, যা আদায়ের জন্য স্পষ্টভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সদকাতুল ফিতরের আরও দুটি তাৎপর্যের কথা একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) সদকাতুল ফিতর অপরিহার্য করেছেন; অর্থহীন, অশালীন কথা ও কাজের কারণে রোজার যে ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণের জন্য এবং নিঃস্ব লোকদের আহার জোগানোর জন্য। (আবু দাউদ)

সদকাতুল ফিতর কখন ওয়াজিব হয়
সদকাতুল ফিতর একজন মুসলিমের ওপর নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলেই ওয়াজিব হয়ে যায়। নিসাব পরিমাণ মানে হলো—সোনা, রুপা, ব্যবসায়িক পণ্য, প্রয়োজনের অতিরিক্ত আসবাবপত্রের মূল্য ও নগদ ক্যাশ—এ পাঁচ ধরনের সম্পদ মিলে বা এর কোনো একটিও যদি সাড়ে সাত ভরি সোনা কিংবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায়, তাহলে তাদের ওপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হয়ে যায়। এখানে লক্ষণীয় হলো, প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ বলতে উদ্দেশ্য হলো—যা বছরে সাধারণত একবারও ব্যবহার হয় না। যেমন—
-অতিরিক্ত কাপড়চোপড়, যা বছরে একবারও ব্যবহার হয় না।
-টেলিভিশন, অবৈধ মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট ইত্যাদি
-শৌখিন আসবাবপত্র—তা ব্যবহৃত হোক বা না হোক। যেমন মাছের এ্যকুরিয়াম, পোষা পাখি ইত্যাদি।
-অতিরিক্ত ডেগ-পাতিল যেগুলো বছরে একবারও ব্যবহার হয় না।
-প্রয়োজনের অতিরিক্ত জমি, যা বছরে খোরাকির জন্য প্রয়োজন হয় না।
-খালি পড়ে আছে এমন ঘরবাড়ি।
এসব বিষয় যদিও জাকাতের নিসাবে ধর্তব্য নয়, কিন্তু জাকাতের অনুপযুক্ত হওয়া, সদকাতুল ফিতর ও কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই ধর্তব্য হবে।

বিবিধ মাসায়েল
ক. সদকাতুল ফিতর ব্যয়ের খাত তা-ই, যা জাকাতের খাত। তবে গরিব-মিসকিনকে দেওয়াই সর্বোত্তম।
খ. যে ব্যক্তি যেখানে বসবাস করছে সেখানকার হিসেবেই সদকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে।
গ. নাবালক ও পাগলের সম্পদে জাকাত না আসলেও সদকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে। তাদের পক্ষে তাদের অভিভাবক তা আদায় করবেন।
ঘ. সদকাতুল ফিতর গ্রহীতাকে যা দেওয়া হবে তার মালিকানা সত্ত্ব প্রদান করতে হবে।

লেখক: শিক্ষক